Thursday, 25 October 2018

সৌহার্দ্য ও শিষ্টাচারঃ ইসলামি দৃষ্টিকোণ


সৌহার্দ্য ও শিষ্টাচারঃ ইসলামি দৃষ্টিকোণ
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

আজকাল পথে-ঘাটে পথচারীদের ভিড়ে, চায়ের দোকান ও রাস্তার মোড়ে, টিভি-পেপারের সংবাদ শিরোনামে, নাটক-উপন্যাস, ফিল্ম-টেলিফিল্ম ইত্যাদির ভিলেন চরিত্রে মুখে পান বা গুটখা, পরনে বিশেষ ধরণের পাঞ্জাবী-পায়জামা, দেশ বিরোধী ইস্যু হলে যত্ন করে পরানো টুপি, মুখে উর্দু-বাংলা মিশ্রিত বুলি ইত্যাদি দিয়ে একটা ছবি তৈরি করা হচ্ছে সমাজের মননে- মুসলিমরা এমনই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বৃহত্তর সমাজের মনে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণার একটা আবহ প্রতিনিয়ত ঘনীভূত হয়ে চলেছেহ্যাঁ সত্যিই, কিছু মুসলিম নানান অসামাজিক ও অকল্যাণকর কাজে জড়িয়ে। তাই বলে কি তার খেসারৎ পুরো মুসলিম জাতিকে দিতে হবে!
আমি মনে করি, সবার জানা দরকার যে- প্রকৃত মুসলিম কে বা কারা? খোদ নবি (সা)-র ভাষায়- ‘যার কথা ও কাজে অন্য কোনো মানুষ আঘাত পায় না সে-ই প্রকৃত মুসলিম’ (আহ্‌মাদ ৭০৮৬, নাসায়ি ৪৯৯৫)হয়তো তারই জন্যে এই ‘পিছিয়ে পড়া’ মুসলিম সমাজে এখনো বহু ইতিবাচক দিক রয়েছে। বিশেষত আদব-কায়দা, সৌহার্দ্য ও শিষ্টাচারের দৃষ্টিকোণ থেকে মানব সমাজের জন্য বহু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে এই অবহেলিত মুসলিম মানসের কাছে। তাঁদের পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ, নিজের সর্বস্ব দিয়ে অপরের সাহায্য করা ইত্যাদি গুণগুলির কথা উনিশ শতকে যেমনটা শরৎ বাবু ‘পল্লীসমাজ’-এ লিখে গেছেন, হয়তো তারই এক ঝলক কেরলের বন্যায় হানান হামিদের উদারতায় লক্ষ্য করা গেল। এমন বহু নজির আমাদের চারিপাশেই রয়েছে; শুধু একটু ঘৃণা ও অবজ্ঞার চশমা খুলে তাকালেই দেখা মিলবে  
যদিও আজকাল বহু মুসলিম যুবককে বৃদ্ধ মা-বাবাকে অবহেলা করতে দেখা যায়; কিন্তু মুসলিম সমাজে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবার মত নিন্দনীয় ঘটনা তেমন নজরে আসেনি। কারণ মুসলিম মানসপটে কোথাও গেঁথে রয়েছে “লোকেদের মধ্যে উত্তম সাহচর্যের সর্বাপেক্ষা অধিকারী তোমার মা (তিনবার) তারপরে তোমার বাবা। তারপরে তোমার অন্যান্য নিকটবর্তীরা” (মুস্‌লিম ২৫৪৮) এবং এ কথাও “মা-বাবা সন্তুষ্ট থাকলে স্রষ্টাও সন্তুষ্ট হন। আর তাঁরা মনঃক্ষুণ্ণ হলে স্রষ্টাও মনঃক্ষুণ্ণ হন” (তির্‌মিযি ১৮৯৯)। এমনকি হিজ্‌রত (সত্যের জন্য দেশান্তরী হওয়া) ও জিহাদ (সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা)-এর সমতুল্য ধার্য করা হয়েছে পিতামাতার সেবা করাকে (মুস্‌লিম ৪৬৩০)। ইসলামি সাহিত্যে, শুধু মা-বাবা নয়, মা-বাবার বন্ধুবান্ধব ও সমস্তরীয় লোকেদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা ও উত্তম সাহচর্য প্রদান করাকে সর্বাধিক পুণ্যময় কাজ ঘোষণা করা হয়েছে (মুস্‌লিম ৪৬৩৮)। আর ভালো ব্যবহার, উত্তম চরিত্র ইত্যাদিকে পুণ্য ও মনে সংশয় উদ্রেককারী ঘৃণ্য কাজগুলোকে পাপ বলে পরিভাষিত করা হয়েছে (মুস্‌লিম ২৫৫৩)। শুধু পিতামাতা নয়, সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আদেশও দেওয়া হয়েছে; আত্মীয়তার বন্ধন ও সম্পর্ক ছিন্ন করা-কে হারাম (নিষিদ্ধ) করা হয়েছে (মুস্‌লিম ২৫৫৪) প্রতিবেশীর প্রতি যত্নশীল হতে বলা হয়েছে (মুস্‌লিম ৪৮৮৬)তবে যদি বাস্তবোচিত ও শরিয়তসম্মত কোনো কারণ থাকে, সেক্ষেত্রে সম্পর্কের ইতি টানা বৈধ (বুখারি ৫৭২৭) হিংসা, বিদ্বেষ ও পশ্চাদ্ধাবন-এর মত যে কাজগুলি সম্পর্ক নষ্ট করে সে-সবকে বর্জন করে ভ্রাতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার বিধানও দেওয়া হয়েছে (বুখারি ৫৭১৮)সালাম ও সম্ভাষণের মাধ্যমে সম্পর্ককে দৃঢ় করা (মুস্‌লিম ৫৪) ও ছিন্ন-সম্পর্ককে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে (মুস্‌লিম ২৫৬০)। বিভিন্ন রীতিনীতি, আচারঅনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পর্ক বলিষ্ঠ করা সামাজিক ইসলামের একটা বড় অধ্যায়। তাই অসুস্থদের সেবা-শুশ্রূষা (মুসলিম ২৫৬৮), পীড়িতদের সাহায্য-সহযোগিতা (মুস্‌লিম ৪৮৭৩), অনাথদের প্রতিপালন (বুখারি ১৪৬৭), দরিদ্র-অভাবীদের অর্থায়ন (সূরাতুল্‌ ইন্‌সান ৮) ইত্যাদি-কে সর্বাধিক পুণ্যময় কাজগুলির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাতে একটি সুষ্ঠু সমাজ গড়ে ওঠে। এবং সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করতে কিছু পারস্পরিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের বিধিবিধানও প্রদত্ত হয়েছে। অতএব ঔদার্য, দানশীলতা ও বিনয় প্রদর্শন (মুস্‌লিম ২৫৮৮)-এর পাশাপাশি পরস্পরের খোঁজ-খবর রাখাও ঈমানি দায়িত্বগুলির একটি।   
জীবন-পথ চলতে, কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে মতানৈক্য ও বিতর্ক জন্মাতেই পারে। তবে বিতর্ক যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয় তার জন্য বাতলে দেওয়া হয়েছে বিনম্রভাবে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সমাধান-অন্বেষণের পথ ও পদ্ধতি। অতএব তর্ক-বিতর্কের সময় একজন প্রকৃত মুসলিমের ভাষা কখনই মর্যাদার সীমাকে লঙ্ঘন করবে না (মুস্‌লিম ২৫৮৭)কণ্ঠস্বর  হবে নমনীয় (সূরা ত্বহা ৪৪)আলোচনা হবে বুদ্ধিদীপ্ত ও যুক্তিপূর্ণ। যুক্তিখণ্ডন হবে উত্তম ও প্রাসঙ্গিক পন্থায় (সূরা আন্‌-নাহাল ১২৫) একজন প্রকৃত মুসলিম দ্বিচারিতাকে বর্জন করে প্রমাণিত ও বাস্তবোচিত সিদ্ধান্তের উপর মনকে স্থির করবেসর্বদা সত্যকে আঁকড়ে থাকবে (মুস্‌লিম ২৬০৭) যাতে সমাজে ঐক্যের সুর অটুট থাকে। কারণ, লোকেদেরকে ঐক্যের মন্ত্রে গেঁথে ন্যায় ও সততার উপর প্রতিষ্ঠিত একটি সুশীল সমাজ গঠন করা ইসলামের মৌল সিদ্ধান্তগুলির একটি (সূরাতু আলে-ইম্‌রান ১০৩-১০৫, মুস্‌লিম ২৫৬৪)যাতে সকলে মিলে আর্থসামাজিক অধঃপতন, মানবিক অবক্ষয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-এর মত বিপর্যয়গুলির মুকাবেলা করতে পারে। আর তাই সুশীল সমাজকে মানব দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে (মুস্‌লিম ২৫৮৬); যাতে তারা একে অপরের ব্যথা-বেদনা অনুভব করে সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে (সূরাতুল্‌ মায়েদাহ্‌ ২)কেউ কারুর প্রতি বিন্দু মাত্র অবিচার না করেবরং সমস্বরে রুখে দাঁড়ায় যে-কোনো নিপীড়ক-শোষক-অত্যাচারীর বিরুদ্ধে (সূরাতুল্‌ হুজ্‌রাত ৯, মুস্‌লিম ২৫৭৭, বুখারি ২৩১২)
বৃহত্তর সমাজের কথা মাথায় রেখে, প্রত্যেককে ব্যক্তিজীবনে সৎ, সত্যবাদী, আমানতদার, প্রতিশ্রুতি পূরণকারী, অতিথি পরায়ণ, ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু, লজ্জাশীল, ন্যায়পরায়ণ, বিনয়ী, দয়ালু ও দানশীল হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিজীবন, গৃহ ও সমাজ-আচারের পাশাপাশি মানুষকে শেখানো হয়েছে পথচারিতার মত বহিরঙ্গানের আদব-কায়দাও যেমন- পথে দৃষ্টি সংযত রাখা, পথিককে সাহায্য করা, ঠিক পথের দিশা দেওয়া, বিনয় ও ভদ্রভাবে লোকেদের জিজ্ঞাস্যর উত্তর দেওয়া (মুস্‌লিম ২১২১) রাস্তা পরিষ্কার (মুস্‌লিম ১৬৬৮) ও প্রশস্ত রাখা (মুস্‌লিম ১৯১৪)-র নিয়ম মেনে স্বচ্ছ পথ ও সমাজ গঠন করা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব
মানব সমাজের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে বহু গৃহপালিত ও অহিংস প্রাণী। তাই ইসলামি সাহিত্যে মানুষের পাশাপাশি অহিংস্র প্রাণীর প্রতিও যত্নশীল হতে বলা হয়েছে। এধরণের প্রাণীকে হত্যা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইসলামে যাবাহ্‌ ও ক্বাত্‌ল দুটি পৃথক জিনিস)। আর তাই, একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখে মেরে ফেলার জন্য এক গৃহিণী নরকের সাজা পায় (মুস্‌লিম ২২৪২)অন্যদিকে, এক পাপাচারী মহিলা এক তৃষ্ণার্ত কুকুরকে জল পান করিয়ে স্বর্গলাভ করে (বুখারি ৩২৮০) হয়তো এজন্যই, নবি (সা) প্রতিদিন ফজরের পর প্রথমে মুরগী-খামারের দরজা খুলে দিতেন। নিজ ঘোড়াটির ঘাড়ে হাত বোলাতেন। এমনকি, বিড়ালের সাথে এক অনুগামীর সখ্যতা দেখে তাঁকে ‘আবু হুরায়রাহ্‌’ (বিড়ালের পিতা) বলে ডাকতে আরম্ভ করেন। অতএব একজন প্রকৃত মুসলিমের সৌহার্দ্য-ক্যানভাসে ব্যক্তিজীবন, পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ- সবার জন্য অতিযত্নে বরাদ্দ থাকবে নির্দিষ্ট স্থান এবং সৌজন্য ও শিষ্টাচারের সেই ছবি প্রকট থেকে প্রকটতর হতে থাকবে প্রতিনিয়ত। এটাই আমার প্রত্যাশা।  
(দৈনিক পূবের কলম, ১২-১০-২০১৮-তে প্রকাশিত)



       



মোনাফেক এখনো আছে...

Image result for jamal khashoggi
মোনাফেক এখনো আছে... 

বিংশ শতাব্দীর চারের দশকের শেষের দিকে আমেরিকা গেলেন সামিরা মুসা। পরমাণু নিয়ে তাঁর গবেষণার কাজকে কেন্দ্র করেই পাড়ি জমিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকে। তখন তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। এই অল্প বয়সেই মিসরীয় মুসলিম মহিলা পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর বেশ নাম্-ডাক হয়েছিল। কিন্তু, ১৯৫২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এক রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান তিনি।

রকেট-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কাজ করছিলেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। নাম ফাদি মোহাম্মদ আল-বাতস। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের নাগরিক। সম্প্রতি নিজ কর্মস্থান কুয়ালালাম্পুরেই নিহত হন তিনি।

আরেক মিসরীয় বিজ্ঞানী ড. সামির নাজিব গবেষণা করছিলেন পরমাণু প্রযুক্তির সামরিক প্রয়োগ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৭ সালে তাঁকেও হত্যা করা হয় মার্কিন শহর ডেট্রয়টে।

১৯৮০ সালের জুনে, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে রহস্যজনকভাবে নিহত হন ইরাকের পরমাণু প্রকল্পের প্রধান ড. ইয়াহ্‌ইয়া আমিন আল-মুর্শেদ। ইরাকি পরমাণু চুল্লিতে ফরাসি সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার জন্য প্যারিসে গিয়েছিলেন তিনি। তিনিও ছিলেন মিসরীয়।

আরও এক মিসরীয় বিজ্ঞানী সাইদ আল-বোদায়ের'কে তার নিজ বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে কিছু অজ্ঞাতপরিচিত দুর্বৃত্ত, ১৯৮৯ সালে। মাইক্রোওয়েভ বিষয়ে কাজ করছিলেন তিনি।
       
লেবাননের এক উদীয়মান পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন রামাল হাসান রামাল। ১৯৯১ সালে, প্যারিসে তাঁকেও খুন করা হয় রহস্যজনকভাবে। 

ক'বছর আগে, ২০০৪ সালে ইরানি পদার্থবিজ্ঞানী মাসুদ আলি মোহাম্মদিকে তেহরানে তাঁর বাসভবনের বাইরে হত্যা করা হয়। কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি।

গত বছর তিউনেশীয় অ্যাভিয়েশন প্রকৌশলী মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে হত্যা করা হয় তাঁর দেশের মাটিতেই। ফিলিস্তিনের খুব বড় সমর্থক ছিলেন তিনি। ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন। নিজ বাসভবনের বাইরে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী হাসান আলি খাইরুদ্দিন রহস্যজনকভাবে নিহত হন। কানাডায় বিশ্ব অর্থনীতিতে ইহুদি আধিপত্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন তিনি। না থামলে মেরে ফেলা হবে- এমন হুমকি আগে থেকেই দেওয়া হচ্ছিল ২৩ বছর বয়সী এই গবেষককে। শেষ পর্যন্ত সেন্ট ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায় তাঁকে হত্যা করা হয়।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, ফ্রান্সে হত্যা করা হয় লেবাননের আরেক বিজ্ঞান-শিক্ষার্থী হিশাম সালিম মুরাদকে। তিনি জোসেফ ফুরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরমাণু পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। 

চলতি বছরের ২৫ মার্চ, গাজার পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি রসায়নবিদ ইমান হোসাম আর্‌-রোযাকে হত্যা করে ইসরাইল।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছেন যে সকল রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক তাঁদের মতে, এসব বিজ্ঞানীদের হত্যার পেছনে হাত রয়েছে বিশ্বের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী দুই গোয়েন্দা সংস্থার। আবার অনেককে অন্য পন্থায় দমন করা হয়েছে। যেমনভাবে অত্যন্ত কৌশল করে দমন করা হয়েছে পাকিস্তানের স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকিকে। তিনি ছিলেন এমআইটির গ্রাজুয়েট। নামমাত্র এক অভিযোগে তাঁকে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে মার্কিন সরকার। তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে পাগল বানিয়ে এক নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। আর এভাবেই সারা বিশ্বে মুসলিম বিজ্ঞানীদের হত্যা করে যেমন নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছে তারা, ঠিক তেমনই 'তিন শ তেরো'র গৌরবধারী এ জাতিকে রণ ও জ্ঞান-ক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখার অপকৌশল করে চলেছে লাগাতার। আরব ও মুসলমানরা যাতে বিজ্ঞান, বিশেষ করে পরমাণু প্রযুক্তি ও সামরিক প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে না পারে সেজন্য এই গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারা। আর কিছু মোনাফেক টাকার বিনিময়ে এমন বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও গবেষকদের তথ্য তাদের হাতে তুলে দিয়েছে, দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে হয়তো।

অভিযোগ রয়েছে, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিও ইসলামপন্থী মানুষদের তথ্য তাদের হাতে তুলে দিতেন। অনেক সময় ইসলামপন্থীদের জঙ্গি তকমা দিয়ে লেখা কলাম বিভিন্ন মার্কিন জার্নালে প্রকাশ করতেন। আর এসবের বিনিময়ে তিনি পেতেন মোটা অংকের টাকা। তবে, এ অভিযোগ কতটা সত্য, কতটা মিথ্যা তা আমার জানা নেই। আর এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করছি, কিছু মানুষ অর্থাৎ সৌদি-পন্থীরা খাশোগির কুৎসা করে চলেছে। অন্যদিকে, কিছু মানুষ অর্থাৎ সৌদি-পরিপন্থীরা খাশোগির স্তুতি গাইছে। আবার যারা আসাদ-পন্থী, সিরিয়া সম্পর্কে তাঁর অভিমত ও কলামগুলোর কারণে তাঁর কুৎসা গাইছে এবং তাঁরও মৃত্যুকে 'গো আসাদ কার্স' হিসেবে বিবেচনা করছে। তাই, তার খুন যেমন মর্মান্তিক তেমনই রহস্যজনক আমার দৃষ্টিতে। হয়তো সময়ের স্রোতে সব কিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে, হয়তো বা অন্যান্য বহু হত্যার মত তার হত্যাও চলমান হত্যাযজ্ঞের সমুদ্রের গভীরে পলি রূপে চাপা পড়ে যাবে...!

বিঃ দ্রঃ ইসলাম কোনোভাবেই এধরণের হত্যাকে সমর্থন করে না। কারণ, ইসলাম একটি প্রাণের হত্যাকে সমগ্র মানবতার হত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে (সুরাতু আল-মায়েদাহ ৩২)। অতএব যে কোনো হত্যার ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। এবং মুস্‌লা (অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির শরীর বিকৃত করা)-ও ইসলামে হারাম।       



Wednesday, 10 October 2018

বিবাহ ও মসজিদঃ প্রসঙ্গকথা

Related image

বিবাহ ও মসজিদঃ প্রসঙ্গকথা 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

অনেক দিন আগে খবরে পড়েছিলামদু’জনেই ডাক্তার। কলেজ থেকেই তাঁদের আলাপ। ডাক্তারি পাশ করার পর সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। দিনক্ষণ পাকা করে বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। সবার মত করে তাঁরাও বিয়ের গাঁটছড়া বাঁধতে উদ্যততবে আয়োজনটা ছিল অদ্ভুত রকমের। হ্যাঁ, সত্যিই বিস্ময়কর। মেয়েটি বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল তাঁর দাদীমা’র বিয়ের শাড়ি ও গয়না পরে। আর ছেলেটি এসেছিল তাঁর বাবার বিয়ের লুঙ্গী আর পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে। দু’জনেই ততদিনে ডাক্তারি পাশ করে চাকরি পেয়ে বেশ নামডাক করে ফেলেছিল। কিন্তু বিয়ের শুভ অনুষ্ঠানটি করেছিল মহল্লার মসজিদে। ওয়ালিমায় নেমন্তন্ন করেছিল পাড়ার এতিমখানার সকল শিশুদের। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরাও উপস্থিত ছিল সেখানে।
আরও এক ডাক্তারের কথা বলি। তিনি বহু আলোচিত-সমালোচিত এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর বিয়ের গল্পটাও বেশ মজার। বাড়ি থেকে মেয়ে পছন্দ করা হল। মেয়ের বাড়ি পুনেতে। বিয়ের অনুষ্ঠানের ভেন্যু নিয়ে উভয় পক্ষের মত ছিল ভিন্ন। পাত্রপক্ষ ছিল বেশ পয়সাওয়ালা। বলতে গেলে বনেদী ঘরানার। চাইলে হরহামেশায় কোনো ফাইভ সটার হোটেল হায়ার করে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে পারে। কিন্তু ডাক্তার বাবু ছিলেন বেশ মিতব্যায়ী। সেই সাথে ধর্মপ্রাণও। তাই উভয়পক্ষকে রাজি করে বিয়ে করলেন এক মসজিদে গিয়ে। আর সেই মসজিদের পাশের হোটেলে দুটো কামরা ভাড়া করলেন আপনজনদের সুবিধার্থে। সেই মসজিদ প্রাঙ্গণেই আয়োজন করা হল তাঁর ওয়ালিমার। বিশেষ অতিথিরূপে আমন্ত্রিত হলেন ঐ মহল্লার এতিমখানার সকলে।
এবারের গল্পটা একটু ভিন্ন স্বাদের। তিনি একজন ব্যবসায়ী। বেশ বড় মাপের। ভারতজুড়ে তাঁর ব্যবসার বহর। ছেলের বিয়ে দেবেন। পাত্রীপক্ষও বেশ পয়সাওয়ালানির্ধারিত দিনে তিনটে বাস ভর্তি বরযাত্রী নিয়ে পৌঁছলেন পাত্রীর বাড়ি। আগে থেকেই কথা হয়ে ছিল, বিয়ে হবে মসজিদে। তাই সবাই উপস্থিত হলেন মসজিদে। কিন্তু বরযাত্রীর মিছিল দেখে পাত্রীর বাবার মাথায় হাত। তিনি তো এত লোকের আয়োজন করেননি। কী হবে এখন! বিস্ময়ের প্রাথমিক রেশ কাটিয়ে একটু থিতু হলেন। ফোনে হোটেল কর্তৃপক্ষকে শিগগিরি অতিরিক্ত ব্যবস্থা করতে বললেন। বিয়ে হয়ে যাবার পর পূর্ব আলোচনা অনুযায়ী প্রত্যেককে একটি করে খেজুর দেওয়া হল। তারপর পাত্রের বাবা দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরার ঘোষণা করলেন। সবাই যে যার জায়গায় গিয়ে বসল। পাত্রীর বাবা-কাকারা ছুটে আসলেন এসব কাণ্ডকারখানা দেখে। জিজ্ঞেস করলেন, না খেয়েদেয়েই চলে যাচ্ছেন কেন? ছেলের বাবা হাসিমুখে বললেন, ভাইজান আপনাকে তো বলেই ছিলাম, আমরা কিছু খাবো না। শুধু একটা করে খেজুর খাওয়ালেই হবে। আপনি তো তা করেছেন। আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, আপনি আপনার মেয়েকে আমাদের দিয়েছেন। আর কী চাই বলুন আমাদের! আমি তো সবাইকে বলে  দিয়েছি, সবার জন্য অমুক জায়গায় ওয়ালিমার আয়োজন করা হয়েছে। মেয়ের বাবা থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলেন, তাহলে দাদা এত লোকজন নিয়ে এলেন কেন? তিনি হাসতে হাসতে উত্তর করলেন, বিয়ে লুকিয়ে নয়, দেখিয়ে করাই সুন্নততবে এও খেয়াল রাখতে হবে, যাতে এসব যেন কোনোভাবেই মেয়ের বাবার জন্য বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়...!
আমাদের ইতিহাসেও তো অমন কথাই পাওয়া যায়। সে-সময়ে দিনরাত সর্বক্ষণ মসজিদের ফাটক খোলা থাকত। গরিব-দুঃখী-অনাথ-আশ্রয়হীনদের মাথা গুঁজবার ঠাই ছিল মসজিদ। অনায়াসেই চলত শিশুকিশোরদের ক্রীড়াকৌতুক, মসজিদ চত্বরেই। রাজনীতির মত গুরুগম্ভীর কাজকম্মের আসরও বসত মসজিদের ভেতরে। বিদেশী দূতদের সাথে আলাপআলোচনাও হত সেখানে। সমাজের বিচার, শালিসী সভা সব। পঠনপাঠন থেকে বিবাহ আরও কতকিছু যে সংঘটিত হত মসজিদের অন্দরে, ইতিহাসের পাতায় তা ধরা আছে। সময়ের সাথে সাথে সব কোথাও হারিয়ে গেল। উবে গেল সেসব রীতি-রেওয়াজ, উধাও হয়ে গেল মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা। আস্তে আস্তে এমন হয়ে গেল যে, আজকাল দু’চারজনই দিনে-রাতে দু’চারবার মসজিদে যায়; অনেকে যায় সপ্তাহান্তে। কেউ কেউ তো তাও করে না। আর এভাবেই মসজিদ হারিয়ে ফেলেছে তার ব্যবহারিক গুরুত্ব! হয়তো তাই আজকাল মসজিদ নিয়ে ভিন্ন রকমের বয়ান দিচ্ছে ওরা!    
এসব পড়ে, জেনে, শুনে আমারও খুব ইচ্ছে ছিল, বিয়েটা করবো মসজিদে, খুব সাধারণ ভাবে। অনুষ্ঠানটা হবে খুব সিম্পল। বিয়েটা পড়াবেন কোনো প্রকৃত ‘মাওলানা’ নিজ মসজিদের মেহরাবের কাছে বসে ওয়ালিমায় অবশ্যই শামিল করবো এলাকার গরীব-দুঃখী-এতিমদের। মোহরের অর্থ নগদ আদায় করবো...। এমন অনেক ভাবনা ছিল মনে। মাইনুদ্দিন স্যারও প্রায়শই আমায় বলতেন, “আব্দুল মাতিন, বিয়েটা মসজিদে করবে এবং খুব সিম্পলভাবে করবে। যাতে সমাজের কাছে সেটা একটা নজির হয়ে থাকে।” কিন্তু, দিনের শেষে আমি ব্যর্থ হয়েছি। বৌভাতে এসে মাইনুদ্দিন স্যার স্মরণ করিয়েছিলেন সে-কথা। আক্ষেপের স্বরে বলেছিলেন,  “আব্দুল মাতিন, তুমিও পারলে না!”                

Monday, 8 October 2018

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ ভিড়তন্ত্রের কবলে



ভিড়তন্ত্রের কবলে 

ছোটবেলায় গল্পটা শুনেছিলাম। সম্ভবত, নানিমা-র কাছে। স্রষ্টা যখন সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন, একজন ফেরেশতা তাঁর নাম মালাকুল্‌ মাউত্‌ - দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, প্রভু আপনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন জান কবজকরার। সবাই তো আমাকে গালাগাল দেবে। অভিশাপ দেবে। স্রষ্টা উত্তর করলেন, তুমি যেমনটা ভাবছ, ঘটনা তার বিপরীত হবে। কোনো প্রাণীর মৃত্যুর পূর্বে সিনারিও এমন তৈরি হবে যে কেউ তোমার কথা খেয়ালই করবে না। সবাই মৃত্যুর কারণ-ঘটনা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করবে। আর সেই সাথে এটা না করলে বেঁচে যেত, ওখানে না গেলে কিছুই হত না’-টাইপ কথা আওড়ে আফসোস করবে। (এই কথাগুলো তত্ত্ব ও তথ্যের বিচারে কেমন তা আমার জানা নেই।)

বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে তিনি সবে দিল্লীর মসনদে বসেছেন। পুনেতে আইটি সেক্টরের কর্মচারী মুহ্‌সিন শেখ নিহত হলেন কিছু অতি-রাষ্ট্রবাদীদের হাতে। কদিন খুব আলোচনা চলল, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। ভেসে উঠল তাঁর মুসলিম চেহারা’-র ছবিটা। সময়ের সাথে সবাই ভুলে গেল; শুধু ভুলতে পারেনি সেই মা যার নাড়ি ছিঁড়ে কোন এক ভোরে পৃথিবীর আলো দেখেছিল মুহ্‌সিন।

আখলাক খুন হলেন। দাদরির কোনো এক মহল্লায়। ফ্রিজে তাঁর মাংস ছিল। মাংসকীসের ছিল তা নিয়ে চলল জোর বিতর্ক-আলোচনা। প্রেস্টিটিউটদের টক শতে। শুনেছিলাম মাংসের কিছুটা ফরেনসিক না কীসব টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছিল। খুনবেমালুম হারিয়ে গেল বিতর্ক ও সময়ের গোলক ধাঁধাঁয়; শুধু হারায়নি আখলাক স্ত্রী-সন্তানদের মন থেকে। তাঁর আর্মি ছেলে হয়তো খুন হওয়া পিতার ছবি মনে ও মোবাইলে নিয়ে কাশ্মীরের কোথাও পাহারা দিচ্ছে তেরঙ্গার আব্রুকে।

জে এন ইউ-র ঢাবা ও জঙ্গলের মাঝে কোথাও হারিয়ে গেল নাজিব। নিখোঁজ সে। কোনো হদিশ নেই তাঁর। তাঁর মার আহাজারি কানকে ছুঁলেই মনে প্রশ্ন জাগে, সবুজে ঘেরা ওই সুন্দর ক্যাম্পাসটির কোথায় আছে বারমুডা ট্রাঙ্গেল-টা? নাজিবের স্বপ্ন-উড়ান যেটাতে ভ্যানিশ হয়ে গেল। হয়তো আজ থেকে পাঁচ বছর পরে সেই নাজিবেরই ডাক্তার ছোট বোনের হাতে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে কোন অতি-রাষ্ট্রবাদী ভক্ত।

সোনে কি চিড়িয়া’-র কোনো না কোনো প্রান্তে সপ্তাহান্তে এমন এক-আধটা ঘটনা শোনাই যায়। যেগুলোতে খুন হয় আফরাজুল-পেহ্‌লু-জুনাইদ-ফারুক-আকবর-রা ভিড়’-এর হাতে। নেপথ্যে থাকে কিছু বাঁধাধরা কারণগোমাংস, গো-তসকরি, গো- হত্যা, লাভ্‌ জেহাদ, ছেলে-পাচারকারী, বাইকচোর ইত্যাদি। বাস্তবের মাটিতে সে-কারণগুলোর সাধারণত কোন অস্তিত্ব থাকে না। তবে গোদি মিডিয়া’-র স্ক্রিনে দেখানো হয় কতকিছু। ফলে আলোচনা-বিতর্ক সবই চলে, তবে খুনের বিষয়কে এড়িয়ে গিয়ে। আর প্রেস্টিটিউট-রা মেতে ওঠেন কু-অজুহাতের নানান মোড়কে ঢেকে সেই হত্যাকে বৈধ সাব্যস্ত করতে। এভাবেই মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হতে থাকে সিনারিওগুলো আর বেমালুম মুক্তি পেয়ে যায় সেই ভিড়’, জান কবজকারী এই দানবরা...!

-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

Sunday, 7 October 2018

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ ভাইয়ের দরদ


ভাইয়ের দরদ
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

সল্টলেক সেক্টর ফাইভের অফিসপাড়াচারিদিক খুব ব্যস্ততখন দুপুর দুটো তিরিশ হবে। রাস্তার পাশের এক চেনা দোকানে চা খাচ্ছে শাহিদএক যুবতী, বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে, ইতস্তত করতে করতে ঢুকলো সেই দোকানেহাতে একটা ট্রান্সপারেন্ট ফাইলদেখা যাচ্ছে, ভিতরে রয়েছে কিছু মার্কশিট ও সার্টিফিকেটসারা শরীরে প্রসাধনের তেমন কোনো চিহ্ন নেই। তবে ঘামে ভেজা ও রোদে মাখা মুখটা ছিল বেশ সপ্রতিভএক পা দু’ পা করে দোকানদারের কাছে গিয়ে বললদাদা, ভাত বা রুটি পাওয়া যাবে?

দোকানদার তখন একটা থালায় ভাত তুলছিল। উত্তর দিল হ্যাঁ, ভাত পাবেনবলুন কী খাবেনডিম, রুই, পাবদা, চারা পোনা, মাছের ডিম, মাংস? বলুন কী দেবো?  
শুধু সব্‌জি ভাত কত দাদা?
ভাত, ডাল, আলুভাজা এবং সোয়াবিনের তরকারি পঁয়ত্রিশ টাকা।
আমার সোয়াবিন চাই না শুধু আলুভাজা আর ডাল দিনতিরিশ টাকায় হবে তো?
হবেবসুন, দিচ্ছি

এরই মধ্যে ওর ফোনটা বেজে উঠল— “হ্যাঁ মা বলো... হ্যাঁ, হ্যাঁ ইন্টারভিউ দিয়েছি... হ্যাঁ আরও কয়েকটা অফিসে যাবো কথা বলতে... হ্যাঁ খেয়েছি... ভাত মাছ... তুমি ওষুধগুলো ঠিকঠাক খেয়েছো তো?... হ্যাঁ আমি পাঁচটার ট্রেনটা ধরবো... ভাইকে টিউশন থেকে ফেরার সময় স্টেশনে দাঁড়াতে বলবে... আচ্ছা, ঠিক আছে, রাখলাম... হুম...

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকলোহয়তো অসুস্থ মা, পড়ুয়া ছোট ভাইকে ঘিরে সাজানো স্বপ্নগুলো চোখে ভিড় করছিলোশাহিদের মনে এক অদ্ভুত রকমের মায়া জন্মাল ওই অজানা-অচেনা যুবতীর প্রতিনারী স্বাধীনতা কী, ওর কাছে শুনতে খুব ইচ্ছে করছিলো তার চাকরির এই আকাল-যুগে ও যে বেরিয়ে এসেছে এই আগুন-রোদের তলায়, নেমে এসেছে এই শক্ত-পাথুরে মাটিতে জীবন-যুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, এখানেই অর্ধেক যুদ্ধ জিতে গেছে সে। মনে মনে তাকে শুভ কামনা জানাল, আর বাকি অর্ধেকটা যে-দিন নিজের চাকরির টাকায় সত্যি সত্যি মাছ ভাত খাবে সে-দিন জিতবে!  

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দোকানদার ভাতের থালাটা নিয়ে হাজির তার সামনে রেখে বললো আমি ভুল করে সোয়াবিনটা দিয়ে ফেলেছি খেয়ে নিন প্লীজআর হ্যাঁ, ওই তিরিশ টাকাই দেবেন বেশি দিতে হবে না।
কিন্তু আমি তো শুধু আলুভাজা...। 
আমি ভুল করে তরকারিটা দিয়ে ফেলেছি। আপনি না খেলে এই খাবারটা পুরোটাই নষ্ট হবে। খেয়ে নিন প্লীজ। ভুলটা তো আমার। তাই তিরিশ টাকাই নেবো।

দোকানদারের সাথে শাহিদের বেশ সখ্যতা। দীর্ঘ দিনের আলাপ তাঁদের। তাঁরা ক’জন সহকর্মী সপ্তাহে প্রায় পাঁচ দিনই তার দোকানে দুপুরের খাবার খায়। ওই যুবতীকে খাবারটা দিয়ে এসে দোকানদার শাহিদের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল ব্যাবসায় শুধু লাভ খুঁজলে হবে দাদা এরকম ভুল করার সুযোগও তো খুঁজতে হবে ওর জোর খিদে পেয়েছিলবনগাঁতে আমার যে-বোনটা থাকে, অবিকল ওর মতো দেখতে। দু’জনই একই বয়সের।

বলে আবারও নির্লিপ্ত মুখে হারিয়ে গেল সে চা-সিগারেট-ভাত-তরকারির দুনিয়ায় শাহিদ ভাবতে লাগল, আজকের এই খণ্ড যুদ্ধে কে জয়ী হল? চাকরির খোঁজে রোদে পোড়া যুবতী, নাকি বনগাঁর সেই যুবতী, নাকি তার দাদা যে সল্টলেকের অথৈ ভিড়ে এক অচেনা যুবতীর মধ্যে নিজের বোনকে খুঁজে নিয়ে দিব্যি আপ্যায়ন করল? হয়তো নিজ নিজ জায়গায় তাঁরা সকলেই জয়ী! তবে মনে মনে সে কুর্নিশ করলো ওই দোকানদারকে এবং ভাবতে লাগলো, জীবন-যুদ্ধ যে কত কঠিন যে বোঝে সে-ই জানে যোদ্ধার রক্ত, ঘাম ও ক্ষিদের মূল্য!

সহকর্মীদের সাথে পায়চারী করতে করতে শাহিদ পৌঁছে গেল অফিস বিল্ডিঙয়ের নীচে। তখনো তার চোখে ভাসছে ওই যুবতীর করুণ মুখটা। লিফটে উঠে ১২ নম্বর বাটান প্রেস করলো। লিফট উপরে উঠতে লাগলো। হঠাৎ তার মনে পড়ল, দু’ সপ্তাহ বাদে তো ইদুল্‌ আজ়্হ়া। তার কলেজ-পড়ুয়া বোন খুব বায়না ধরেছে এবার এক খানা ভালো এন্ডরোয়েড কিনে দিতে। মনে মনে স্থির করলো, “আমি না হয় আরও দু’ মাস নিজের ভাঙ্গা ফোনটাই ইউজ করবো। তবে এবার ঈদে বোনকে একটা ভালো এন্ডরোয়েড কিনে দেবোই।”   

২১-০৯-২০১৮  
কোলকাতা-৩৯