Saturday, 25 November 2017

বদিউর রহমানঃ অভিপ্রায়

অভিপ্রায়
বদিউর রহমান

আরবী সাহিত্যে মরুভূমির সতত প্রতিচ্ছবি
যেখানে নিলোফারের দেখা মেলে ভাগ্যবানের
প্রখর সূর্যকিরণের শাণিত বর্শাফলকে
হয়েছি বারংবার ক্ষতবিক্ষত

বেদুইন চরিত্রের সঙ্গে মেলাতে পারিনি হাত
শত চেষ্টাতেও হতে পারিনি একাত্ম;
নিশিদিন এঁকেছি মরূদ্যানের ছবি
স্বপ্ন ভেঙেছে খান খান

অজানা অচেনা মরুপথে
ক্লান্ত এ পথিক;
বৃষ্টিভেজা শীতল তরুছায়ার আশায়
আজ আমি অস্থির চাতক

লায়লা-মজনুর প্রেম আখ্যানে
আর মজে না মন
কায়েসের ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি
আর যোগায় না সাহস

উনায়যার তাঁবু-সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায়
আর ভরে না প্রাণ
শানফারা আনতারার রণহুঙ্কারে
বেদুইন শোণিত হলেও উষ্ণ
হিমপ্রবাহ এ বঙ্গসন্তানের শিরায়
শিহরে ওঠে রক্তপাতের ভয়ে।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের যুদ্ধদামামা থেকে
অনেক যোজন দূরে
শান্তির নীড় খোঁজে এ মন।
উকায মেলার কাব্য মালা
সুখপাঠ্য হয়ে থাক মোআল্লাকায়;
এবার বাড়ী ফেরার পালা।

ছোটবেলার মত
গরুর গাড়ীর ছৈ-এ বসে
যেতে চাই বারানতলায়।
ফেরার পথে
এক হাতে বাদামভাজার ঠোঙ্গা,
অন্য হাতে ভেঁপুর বাঁশি নিয়ে
ছৈ এর দুলুনিতে
ঘুম চোখে ফিরে যেতে চাই
অখ্যাত গ্রামের বাড়িতে।

এখানে ধুলোবালির অদ্ভুত গন্ধ
এখানে গাছের পাতা ঘন সবুজ,
পাখির গান মধুর,
দীঘির জল নীল, গভীর।

অন্তহীন মরুভূমির মরীচিকার পিছনে দৌড়ে
আজ আমি ক্লান্ত, অবসন্ন।

এবার বাংলার সবুজে
সুখশয্যার সময়।
এ মাটির সোঁদা গন্ধের মাঝে
এবার শুয়ে থাকার পালা।

রচিও শয্যা আমার
বকুলের ছায়ায়;
সেখানে কিছু দূর্বাঘাস, তরুলতা যেন থাকে।
ক্লান্ত আরব বেদুইন এখন
বাংলা মায়ের কোলে চিরনিদ্রায় মগ্ন।


CUTA- Tea club-এ পঠিত
৩১/০১/২০১১

…………………………………………………………………………………
টীকাঃ-
) ইমরাউল কায়েসঃ প্রাক-ইসলামী যুগের সর্বাধিক খ্যাত তথা আরবী সাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম বিখ্যাত কবি অশ্বের বর্ণনার নিপুণতায় তিনি অনুপম মৃত্যু ৫৪০ খ্রীঃ(ফাখুরী)
) ইমরাউল কায়েসের প্রেমিকা তথা মুয়াল্লাকা কাব্য রচনার প্রেরণাযার সঙ্গে প্রেমলীলার কাহিনী বিবৃত হয়েছে উক্ত কাব্যের ছত্রে ছত্রে
) শানফারাঃ প্রাক-ইসলামী যুগের দুঃসাহসী যাযাবর কবি, যারলামিয়াতুল আরবকাব্য আরবী সাহিত্যের অনন্য সম্পদ মৃত্যু ষষ্ঠ শতকের প্রথমদিকে(ফাখুরী)
৪) আনতারাঃ মুয়াল্লাকার অন্যতম কবিরূপে গণ্য করা হয়। প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ-সম্পন্ন, বীর, যোদ্ধা কবি। মৃত্যু ৬১৫ খ্রীঃ (ফাখুরী)
৫) প্রাক-ইসলামী যুগে অনুষ্ঠিত তিনটি বৃহত্তম মেলার মধ্যে একটি। মক্কার দক্ষিণ-পূর্বে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলাহ নামক স্থানে এই মেলা বসত। স্বনামধন্য কবিদের সাহিত্য আসরে মুখরিত হতো উকাযের মেলা প্রাঙ্গণ।

৬) প্রাক-ইসলামী যুগ তথা সর্বকালের অন্যতম সেরা আরবী সাহিত্য সম্পদ। আব্বাসী যুগের প্রারম্ভে হাম্মাদুর রাবিয়াহ কর্তৃক সংকলিত এই গ্রন্থে সাতজনের কাব্য স্থান পেয়েছে। কারও মতে দশজনের।

Related image
ক্লান্ত আরব বেদুইন এখন... 

Thursday, 23 November 2017

ভালো থেকো

ভালো থেকো
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

ঈষৎ অবনত মস্তক। আঁখি জলে ছলছল চোখ। গোলাপ-রাঙা আঙুলে আমার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু বিন্দুটিকে মুছে দিয়ে, চাপা কান্নার সাথে মিশে নির্গত হওয়া অস্ফুট ও অস্পষ্ট স্বরে, শেষবারের মতো সে বলল-
'ভালো থেকো।'

আশীর্বাদও যে কখনো কখনো অভিশাপ হয়, সেদিনই প্রথম অনুভব করেছিলাম।



বিচ্ছেদের মুহূর্তে... 



Monday, 20 November 2017

শায়েরুল কুতরাইন খালীল মুতরান


খ়ালীল মুত়্রান
(১৮৭২ ১৯ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
জন্ম ও পরিচয়ঃ
আরবী সাহিত্য কানন যে সমস্ত সাহিত্যিকদের আগমনে সুশোভিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন স্মরনীয় ব্যক্তিত্ব হলেন খলীল মুতরান। শা‘য়েরুল্‌ কুত্‌রাইন খলীল মুতরান ছিলেন আধুনিক আরবী কাব্যজগতের প্রাণপুরুষ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ১লা জুলাই লেবাননের বালবাক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল মুতরান ছিলেন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী এবং গন্যমান্য ব্যবসায়ী। তাঁর ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মাতা ছিলেন কবি-প্রতিভার অধিকারিণী, যে প্রতিভা সঞ্চারিত হয়েছিল মুরতানের মধ্যেও।
 
বাল্যকাল ও শিক্ষাঃ
যাহ্‌লা শহরের আল্‌-কুল্লিয়্যাতুশ্‌ শার্‌কিয়্যাহ্‌ নামক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার্জনের পর বেইরুতের একটি বিশপ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে আরবী ভাষার পাশাপাশি ফরাসীতেও যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সেখানে অধ্যায়নবস্থাতেই তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফুরন ঘটে। যার ফল স্বরূপ স্বদেশবাসীর উপর উসমানী শাসকদের অত্যাচারের প্রতিবাদে “মা’রাকাতু আয়ানা” শীর্ষক কবিতা রচনা করলে তা শাসক দলের কুনজরে পড়ে। সরকার তাকে বিদ্রোহী, অস্থিরতা সৃষ্টিকারী রূপে চিহ্নিত করে। পরবর্তীতে স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষা শুরু করলেও তা সম্পূর্ণ করতে না পারায় বলা হয়, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে।
 
বিদেশগমনঃ
সরকারী গোয়েন্দাদের কুদৃষ্টি এবং আক্রম থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে ১৮৯০ সালে তিনি প্যারিস যাত্রা করেন। সেখানে তিনি ফরাসী সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে নিজেকে সমৃদ্ধ করেনসেখানেও একটি তুর্কী সরকার বিরোধী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তুর্কী সরকারের দূতাবাস তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। ফলে প্যারিস ত্যাগ করে লাতিন আমেরিকা যাবার মনস্থ করেও পরে মিশরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মতো ১৮৯২ সালে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া অভিমুখে যাত্রা করেন।
 
কর্মজীবনঃ
তিনি জীবনে নানা ধরণের পেশার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। যেমন— (ক) সাংবাদিকতা, মিশরে পৌঁছেই সেখানকার দৈনিক আল্‌-আহ্‌রাম পত্রিকার সম্পাদক সেলিম তাক্‌লার মৃত্যুতে একটি শোকগাথা রচনা করলে তা সেলিমের ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।। তিনি ১৮৯৩ সালে কবিকে উক্ত পত্রিকার সাংবাদিক নিযুক্ত করেন। কবি আল্‌-আহ্‌রাম-এর পাশাপাশি আল্‌-লিওয়া এবং আল্‌-মুবাদ পত্রিকাতেও লেখালেখি করেছেন।
 
(খ) সম্পাদনা, আল্‌-আহরামে সাংবাদিকতার কিছুকাল পর সম্পাদক পদে উন্নীত হন। এছাড়া ১৯০০ সালে তিনি নিজে একটি পাক্ষিক প্রকাশ করেন আল্‌-মাজাল্লাতুল্‌ মিস্‌রিয়্যাহ্‌ নামে। ১৯০২ সালে শায়খ ইউসুফের সঙ্গে মিলিত হয়ে উভয়ে যৌথ উদ্যোগেই পাক্ষিককে দৈনিক আল্‌-জাওয়ায়িবুল্‌ মিস্‌রিয়্যাহ্‌-তে রূপান্তরিত করেন।
 
এছাড়াও ১৯১২ সালে তিনি কৃষিসংঘের সহকারী সচিব নিযুক্ত হন। মাঝে কিছুদিন ব্যবাসায় মনোনিবেশ করেন। আবার ১৯৩২ সালে কবি শাওকীর মৃত্যুর পর অ্যাপোলোর সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৩৫ সালে জাতীয় নাট্যদলের সভাপতি হন।
পরলোকগমনঃ
স্বভাব কবি মুতরান বহু সাহিত্য সেবার পর ১৯৪৯ সালের ১লা জুলাই ৭৭ বছর বয়সে কায়রোতে মৃত্যু বরণ করেন।
 
কাব্য-বৈশিষ্টঃ
তিনি ছিলেন সহজাত কবি প্রতিভার অধিকারী। তাঁর কবিতায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় লক্ষ করা যায়তাঁর অনুভূতি বোধ ছিল সূক্ষ্ম প্রখর বিশ্লেষণ ক্ষমতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট। অত্যন্ত স্বচ্ছ কাব্যশৈলীর অধিকারী ছিলেন। তাঁর যে কোনো কবিতার বিষয়বস্তু বিক্ষিপ্ত না হয়ে একক বিষয় কেন্দ্রিক ছিল। পাশাপাশি পাশ্চাত্য তথা ফরাসী কবিদের সাহচর্যে তিনি ফরাসী রোমান্টিকতায় প্রভাবিত হন, যা তার বিভিন্ন প্রেমমূলক কবিতায় পরিস্ফুটিত হয়। তিনি নিজেই বলেন, আমার কবিতার তিন চতুর্থাংশই হল প্রেমের কবিতাতিনিই সর্বপ্রথম আশ্‌-শে‘রুল্‌ কাসাসী বা কাহিনী নির্ভর কবিতার প্রবর্তন করেন। আর এ ধরণের কবিতার অধিকাংশ উপজীব্য তিনি ইতিহাস এবং বাস্তব জীবন থেকে গ্রহণ করেন।
 
সাহিত্য সম্পদঃ
তাঁর অসংখ্য সাহিত্যকীর্তি আরবী সাহিত্য ভাণ্ডারের উজ্জ্বল রত্ন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— (১) দীওয়ানুল খলীল (চার খণ্ডে সমাপ্ত তাঁর কাব্য সংকলন)। (২) আল্‌-মুজায্‌ ফী ‘ইল্‌মিল্‌ ইক্‌তেসাদ, মির্‌আতুল্‌ আইয়াম ফী মুলাখ্‌খাসিত্‌ তারীখিল্‌ ‘আম এ দুটি তাঁর ফারসী থেকে আরবীতে অনুদিত গ্রন্থ। (৩) ইলাশ্‌ শাবাবযুবকদের প্রতি উপদেশমূলক কাব্যসংকলন। (৪) শেকস্‌পীয়রের বিখ্যাত নাটকের আরবী অনুবাদ, যথাওথেলো, মার্চেন্ট অব ভেনিস, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, ইত্যাদি।
 
সম্মানপ্রাপ্তিঃ
জীবনে তাঁর কাব্যকবিতা, প্রতিভা ও ব্যুৎপত্তির জন্য তিনি নানা ধরণের সম্মান ও সম্বর্ধনা লাভ করেছিলেন। যেমন, (১) ১৯১৩ সালে মিশর বিশ্ববিদ্যালয় ( বর্তমানে যেটি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) তাঁকে বিশেষ সংবর্ধনা দেয়। (২) ১৯৪৭ সালে অপেরা হাউসে তাঁর সম্মানে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করা হয়, যেখানে তাঁকে শা‘য়েরুল্‌ কুত্‌রাইন শা‘য়েরুল্‌ আক্‌তার আল্‌-‘আরাবিয়্যাহ্‌ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
 
তাঁর উৎকৃষ্ট মানের একাধিক কবিতা রয়েছে, যা আজও পাঠককুল ও কাব্যমোদীদের মোহিত করে তোলে। তাঁর একটি অপূর্ব কবিতা হল আল্‌-মাসা (সন্ধ্যা)। সেই কবিতায় তিনি বলেছেন—
داء ألم فخلت فيه شفائ                   من صبوتي، فتضاعفت برحائ
ياللضعيفين! إستبد بي                    وما فى الظلم مثل تحكم الضعفاء

শায়েরুন নীল হাফিয ইবরাহীম


শা‘য়েরুন্‌ নীল হাফিয ব্‌রাহীম
(১৮৭২ ১৯৩২ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
জন্ম ও পরিচিতিঃ
মিশর হতে পরাধীনতার শৃংখলকে দূরীভূত করার ক্ষেত্রে যে গুণীজনেরা মিশরবাসীদেরকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি মুহাম্মদ হাফিব্‌রাহীম। আধুনিক মিশরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বৈপ্লবিক চেতনা সঞ্চারকারী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীনতা ও জাতীয় জাগরণের কবি ছিলেন তিনি। তিনি শুধুমাত্র একজন প্রথম শ্রেণীর কবিই ছিলেন না বরং একজন প্রথম শ্রেনীর সাহিত্যিক ছিলেন। সাহিত্যিক ল্‌-মানফালুতি তাঁকে একজন প্রথম শ্রেণীর কবি ও প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক গণ্য করেছেন।
 
জাতীয় সেবা ও দুস্থ মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ ছিলে তিনি। খানিকটা বাংলার বিদ্রোহী কবি নজরুলের মতই তাঁর কবিতাতেও বিদ্রোহের স্বর শোনা যায়। তাঁর বিদ্রোহ ছিল ঔপনেবিশিক শাসন, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সামাজিক পুনর্গঠন, জাতীয় চেতনায় উদ্ধুদ্ধকরণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মূর্খতা ও কুসংস্কারের মুখোশ উম্মোচনই ছিল তাঁর কাব্যেকবিতার বিষয়বস্তু। নীলনদ অববাহিত মিশরীয় গণজীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাংখা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন দিক তাঁর কবিতায় স্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। সেজন্যই তিনি প্রাচ্যে শায়েরুন্‌ নীল বা নীল নদের কবি উপাধিতে ভূষিত হন।
 
তাঁর জন্ম এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৭২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী মিশরের উত প্রদেশের দায়রুত শহরের নিকটে নীল নদের উপকন্ঠে নোঙ্গর করা একটি জাহাজে হয়েছিল তবে তাঁর জন্ম সন নিয়ে মতভেদ রয়েছে।   
 
প্রতিপালনঃ
মাত্র দুবছরের, মতান্তরে চার বছরের সন্তান রেখে ওই জাহাজের প্রকৌশলী তাঁর পিতাব্‌রাহীমফান্দী ফাহিমী দায়রুতে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মা হানি বিন্‌তুহ্‌মাদ আল্‌-বুর্‌সাহ্‌ কবিকে নিয়ে কায়রো শহরে নিজ ভাই অর্থাৎ কবির মামা মুহাম্মদ আফান্দী নিয়াজী বাড়ীতে চলে আসেন। পিতা মিশরীয়, আর মাতা তুর্কী বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে কবির ধমনীতে রক্তের সংমিশ্রন তাঁকে জন্মগত প্রতিভাধর করে তুলেছিল। মামার পৃষ্ঠপোষকতায় কবি প্রথমে আল্‌-মাদ্‌রাসাতুল্‌ খায়রিয়্যাহ্‌, মাদ্‌রাসাতুল্‌ মুব্‌তাদিয়ান ও আল্‌-মাদ্‌রাসাতুল্‌ কারীবাহ্‌-তে বিচ্ছিন্নভাবে প্রাথিমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর খিদিভ স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৮৮৬ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মামা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, পেশাগত কারণে সরকারী নির্দেশে বদলী হলেন তানতায়, তাই কবিতাঁর সাথে যেতে হল।
 
আইন ব্যবসায়ঃ
তানতা এসে তিনি আব্দুল ওয়াহাব আন্‌-নাজ্জারের সাথে পরিচিত হন। এবং দুঃখ দৈন্যের মাধুরী দিয়ে নিরলস কাব্য চর্চায় ব্রতী হন। পড়াশুনা ছেড়ে কবিতায় এমন মনোযোগী দেখে মাম মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তা দেখে কবি মামার উদ্দেশ্যে দু’ লাইন লিখে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। চিন্তাভাবনা করে ওকালতির পেশায় মনোনিবেশ করলেনকিন্তু ওকালতী পেশায় মন না বসায় কায়রোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন  
 
সামরিক জীবনঃ
১৮৯০ সালে কুড়ি বছর বয়সে সামরিক প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেলেন। সেখান থেকে ১৮৯১ সালে সামরিক বিভাগে স্নাতক হলেন তার তিন বছর পর তাঁকে পুলিশ বিভাগের ইনস্‌পেক্টর পদে বদলি করা হ কিছু দিন পর পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে আসলে্লেনফিরে এসে অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিচক্ষনতার জন্য সাফল্যের সঙ্গে সামরিক অফিসার পদে উন্নীত হলেনএ সময় লর্ড কিচনারের সেনাপতিত্বে সুদানের উপর হামলা চালানো হয়তখন কবিকে লেফটেন্যান্ট হিসেবে সুদানে প্রেরণ করা হয়। এই দেশান্তরে কারণে ভাবুক কবির মন উতলা হয়ে ঠে। বাধ্যতামূলক সুদানে অবস্থান তাঁর কাছে নির্বাসন মনে হয়। তাই স্বদেশের মাটি মিশরে ফিরে আসার জন্য আবেদন জানানকিন্তু তা না-মঞ্জুর হয়। সুদানে ইংরেজ অফিসারদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন যে, যে কোনো বিষয়েই ব্রিটিশ অফিসাররা মিশরীয় অফিসারদের উপর অবজ্ঞা ও ঘৃণার ভাব দেখায়। মিশরীয় অফিসাররা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ঠে। কবিও সেই বিদ্রোহে ইন্ধন যোগান ও ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করেন। বিদ্রোহীদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়অতঃপর কবিকেও সংরক্ষিত সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত করা হয়। ফলে ১৯০১ সালে সামান্য অংকের পেনশন নিয়ে তিনি মিশরে ফিরে আসেন।
 
জনগণের কবিঃ
মিশরে ফিরে কবি বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুফ্‌তি মুহাম্মদ আবদুহুর বিপ্লবী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সাহচর্যে দেশ ও জাতীয় সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ইতিপূর্বে তিনি ১৮৯৯ সালে আবদুহুর সম্বর্ধনা সভায় প্রশংসাগাথা লিখে তাঁর সৌহার্দ্য লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে আবদুহুর মৃত্যুতে রচিত শোকগাথায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুর অনুভূতি গভীর ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে।
 
এরই মাঝে ১৯১১ সালে শিক্ষামন্ত্রী হাশ্‌মত পাশার সহযোগীতায় মিশরের জাতীয় গ্রন্থাগার দারুল্‌ কুতুব আল্‌-মিস্‌রিয়্যাহ্‌-এর সাহিত্য বিভাগের পরিচালক নিযুক্ত হন ১৯৩২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আমৃত্যু তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন
 
কাব্য প্রতিভাঃ
আরবী কবিতায় আধুনিক ভাবধারা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা উনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে শুরু হয়। কবিতায় আঙ্গিক গঠন, বর্ণনা কৌশল, উপমা নির্বাচন সব কিছুতেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পরিদৃষ্ট হয়। প্রাচীনপন্থী কাসীদা, গানের স্থলে উঠে আসে সনেট, টিউলেট, সম্পুর্ন নতুন আঙ্গিকের খন্ড কবিতা। তাছাড়া ভাবের প্রর্যতা, বর্ণনার সাবলীলতা। ভাষা সহজ-সরল বিষয়বস্তু ক্লাসিকধর্মী গতানুগতিক নয়। আর ব্যাপারে তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী। তাঁর রেনেসাঁ আধুনিক আরবী কাব্যাকাশের সর্বক্ষেত্রে সুললিত কাব্য-ঝংকার তুলেছিল
 
তিনি ছিলেন গোটা আরব জাহান বিশেষ করে মিশরের জনগণের কবি। আরবী কবিতায় জাতীয়তা বোধের প্রেরণা তাঁরই প্রথম সৃষ্টি। সমাজ, জাতির আশা-আকাংখা ও সমকালীন ঘটনাবলীর অবিকল চিত্রাঙ্কনে তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। পণ্ডিত ও সাহিত্যিক হুসাইন হায়কাল তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, হাফিব্‌রাহীমের কাব্যে তাঁর সমসাময়িক মিশরের জাতীয় জীবনের বৈশিষ্ট স্বর্ণরূপে ফুটে উঠেছেস্বদেশের প্রতি অগাধ প্রেম, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি তাঁর কবিতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্টি জনগণের সুখে-দুঃখে আশা-আকাংখায় তিনি ছিলেন মুহ্যমান তিনি ভিক্টোর হুগোর লজ এঞ্জেলস, শেক্স পিয়ারের ম্যাকবেথ ও বহু ফরাসী কবিতা আরবী কাব্যকারে অনুবাদ করেছেনএছাড়া সমর চেতনামূলক, প্রগতিশীলতামূলক নুতন আঙ্গিকে ও সাবলীলতায় গদ্য ও পদ্য উভয় ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদা রেখে গেছেন।