Thursday, 18 September 2025

হাদীস ও সমার্থক শব্দাবলীঃ অর্থের নিরিখে

 


হাদীস সমার্থক শব্দাবলীঃ অর্থের নিরিখে

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

হাদীস শব্দটি মুসলিম সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে অধিক ব্যবহৃত ও পরিচিত। এটি মূলত আরবি ভাষার শব্দএর বিপরীত শব্দ কাদীম অভিধানে হাদীস-এর অর্থ নতুন আর কাদীম-এর অর্থ পুরাতন [আল-কামূস /১০৪, আক্রাবুল মাওয়ারিদ /১৭০] হাদীস শব্দটি কথাবার্তা, আলাপ, খবর ও বানী-এর অর্থেও ব্যবহার হয় পবিত্র আল-কুরআনে রয়েছে— “তারা (যারা নবী সাঃ-এর বিরোধিতা করছে) যদি সত্যবাদী হয় তাহলে এই আল্‌-কুরআনের মতো একটি হাদীস অর্থাৎ বানী নিয়ে আসুক” [সূরা আত-তূর ৩৪] তাছাড়া মানুষ কোনোরকম গভীর চিন্তাভাবনা ছাড়াই যে নিত্যনতুন শব্দাবলী তৈরি করে, সেই শব্দগুলোকেও আরবিতে হাদীস বলে ভাষাবিদদের মতে, এর বহু বচন আহা-দীস আর তাই বিস্ময়কর কল্পনাতীত ঘটনাবলীর বর্ণনাকে আহা-দীস বলা হয়েছে পবিত্র আল-কুরআনে রয়েছে— “অতঃপর আমি তাদেরকে (সাবা নগরীর অধিবাসীদেরকে) আহা-দীস অর্থাৎ প্রবাদ-কাহিনীতে পরিণত করেছি। [সূরা সাবা ১৯] ঠিক তেমনই খবর ও সংবাদ-এর অর্থেও হাদীস শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় পবিত্র আল-কুরআনে রয়েছে— “তোমার নিকট নবী মূসা আঃ-এর হাদীস অর্থাৎ খবর পৌঁছেছে কি?” [সূরা তাহা , সূরা নাজিআত ১৫] বিখ্যাত ভাষাবিদ ইমাম রাগিব আল-আস্ফাহানী এর অর্থ প্রসঙ্গে বলেছেন, এমন কথা যা জাগ্রত অবস্থায় বা প্রত্যাদেশ মারফৎ মানুষের নিকট পৌঁছোয়, তাকে হাদীস বলে

পরিভাষায় হাদীস বলা হয় নবীজির কথা, কাজ মৌনসমর্থনের বর্ণনাকে আর মর্মে সুন্নত শব্দটি হাদীসের সমার্থক ইমাম সাখাবী (রাহঃ)-এর মতেকথা, কাজ মৌনসমর্থনের পাশাপাশি নবীজির গুণাবলী, জাগ্রত নিদ্রিত অবস্থায় তাঁর গতিবিধির বর্ণনাও হাদীস আর ক্ষেত্রে হাদীস শব্দটি সুন্নতের তুলনায় ব্যাপক অর্থ বহন করে [ফাত্হুল মুগীস ] হাদীস শাস্ত্রের বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম ইবনু হাজার আল-‘আস্কালানী (রাহঃ) বলেছেনপূর্বে সাহাবা (নবীজির সহচর), তাবেয়ীন (সাহাবাদের সহচর) তাবা’-তাবেয়ীন (তাবেয়ীনদের সহচর)-দের কথা, কাজ ফাত্ওয়াহ্‌ (কুরআন হাদীসের আলোকে উদ্ভাবিত সিদ্ধান্ত মতামত)-কেও হাদীস নামে অভিহিত করা হতো [নুজহাতুন নাজার ৯৩] তবে পরবর্তী সময়ে বিষয়গুলোকে আরও স্পষ্ট করার জন্য পৃথক স্বতন্ত্র পরিভাষা তৈরি করা হয় ফলে নবীজির কথা, কর্ম মৌনসমর্থনের বর্ণনাকে হাদীস বলা হয় আর সাহাবাদের কথা, কাজ মৌনসমর্থনের বর্ণনাকেআসারএবং তাবেয়ীন তাবা’-তাবেয়ীনদের কথা, কর্ম সমর্থনকে ফাত্ওয়াহ্নামে অভিহিত করা হয় [মুকাদ্দামা সাহীহ বুখারী ১৩]

হাদীস-এর পরিভাষাকে বোঝাতে হাদীস-এর পাশাপাশি আরও তিনটি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় প্রথমটি হলআসার এর আভিধানিক অর্থ কোনো বস্তুর এমন চিহ্ন যা তার অস্তিত্বকে প্রমাণ করে [আল-মুফরাদাত ] এর বহু বচন-সা- পবিত্র আল-কুরআনে রয়েছে— “তোমরা মহান আল্লাহ্ করুণার-সা-অর্থাৎ চিহ্নাবলীর প্রতি লক্ষ্য করো [সূরা আর-রূম ৫০] এছাড়া কোনোকিছুর অবশিষ্ট অংশকেও-সা-বলা হয় [আকরাবুল মাওয়ারিদ /, আল-কামূস /২২৪] যেমন পবিত্র আল-কুরআনে জ্ঞানবিজ্ঞানের অবশিষ্টাংশকে-সা-রাহ্‌’ বলা হয়েছে— “তোমরা আমার নিকট পূর্বের কোনো বই অথবা জ্ঞানের কোনো-সা-রাহ্‌’ অর্থাৎ অবশিষ্টাংশ নিয়ে এসো [সূরা আল-আহকাফ ] তবে পরিভাষায়আসারশব্দের চার রকম অর্থ পাওয়া যায় একহাদীস-এর সমার্থক শব্দ, অর্থাৎ নবীজির কথা, কাজ মৌনসমর্থন হলআসার দুইসাহাবা তাবেয়ীনদের কথা, কাজ মৌনসমর্থন তিনকেবলমাত্র সাহাবাদের কথা, কাজ সমর্থন, খোরাসানের ফিক্ শাস্ত্রবিদেরা এই অর্থে ব্যবহার করতেন চারসালাফ বা পূর্ববর্তী ওলামাদের বানী, ইবনু আলী আল-ফারেসী (রাহঃ) বলেন— ফিক্ শাস্ত্রের পণ্ডিতেরা এই অর্থে ব্যবহার করতেন [জাওয়াহিরুল উসূল ১০, নুজহাতুন নাজার ৮৬, তাদ্রীবুর রাবী ] অর্থের এই তারতম্যের কারণেই বিভিন্ন গ্রন্থে শব্দটির সম্বন্ধবাচক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়; যেমন-সা-রুর্রাসূল’ (নবীজির আসার) এবং-সা-রুস্সাহাবা’ (সাহাবাদের আসার)ইমাম নাবাবী (রাহঃ) প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ববর্তী অধিকাংশ মুহাদ্দিস (হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞরা) বিদ্বানেরা নবীজি সাহাবাদের হাদীসকেআসারনামে অভিহিত করা পছন্দ করতেন আর তাই আমরা লক্ষ্য করি, ইমাম তাহাবী (রাহঃ) নিজ সংকলন গ্রন্থ (যাতে নবীজির হাদীস সাহাবাদের আসার সংকলন করেছেন)-এর নাম রেখেছেনশার্হু মাআনীল -সা- আর ইমাম তাবারী (রাহঃ)- তাঁর একটি সংকলনের নাম দিয়েছেনতাহ্জীবুল -সা-”; তাঁর এই সংকলনটি মূলত নবীজির হাদীস সম্বলিত, তবে আনুসঙ্গিকভাবে সাহাবাদের আসারও উদ্ধৃত হয়েছে

দ্বিতীয় পরিভাষা হলখবর এর আভিধানিক অর্থ সংবাদ রাখা বা কোনো জিনিস জানা পবিত্র আল-কুরআনে রয়েছে— “তোমরা যা কিছু করো মহান আল্লাহ্সবকিছুর খবর রাখেন” [সূরা আলে ইমরান ১৫৩, আত-তাওবাহ্১৬, আল-মুজাদিলাহ্১৩, আল-মুনাফিকূন ১১] এবং যা কিছু বর্ণনা করা হয় কথায় প্রকাশ করা হয় তাকেও খবর বলে [আল-মুফরাদাত ১৪১, আক্রাবুল মাওয়ারিদ /২৫৪] আর পরিভাষায় খবর-এর তিন রকম অর্থ রয়েছে একহাদীস-এরই সমার্থক, অর্থাৎ নবীজির কথা, কাজ অনুমোদন দুইনবীজি সম্পর্কে বর্ণীত ইতিহাস ঘটনাবলী এজন্যই যারা ইতিহাস চর্চা করে তাদেরকেআখবারী’ (ইতিহাসবিদ) বলা হয়; আর যারা হাদীস চর্চা করে তাদেরকেমুহাদ্দিস’ (হাদীস শাস্ত্রের পণ্ডিত) বলে তিনখবর হাদীস-এর চেয়ে ব্যাপক অর্থ বহন করে তাই প্রত্যেকটি হাদীসই খবর, কিন্তু প্রত্যেকটি খবর হাদীস নয় কেননা, কেবল নবীজির নিকট হতে বর্ণীত কথা, কাজ অনুমোদন হাদীস পক্ষান্তরে, নবীজি অন্যান্যদের নিকট হতে বর্ণীত বিষয়সমূহ খবর ফলে খবরের উৎস নবীজি ছাড়া সমকালীন যে কোনো মুসলিম এমনকি অমুসলিমও হতে পারে আর তাই প্রত্যেক মুহাদ্দিস স্বভাবতই আখবারী, কিন্তু প্রত্যেক আখবারী মুহাদ্দিস নয় [নুজহাতুন নাজার -]

তৃতীয় পরিভাষা সুন্নাহ এর আভিধানিক অর্থ পথ, পন্থা, চরিত্র নিয়মনীতি ইত্যাদি [আকরাবুল মাওয়ারিদ /৫৫০] আর ইসলামী শরীয়তের পরিধিতে এর অর্থ নবীজির নির্দেশ নিষেধ [নিহাইয়াহ্/২০১] এজন্যই শরীয়তের বিভিন্ন আলাপআলোচনায়কিতাব সুন্নাহ” (কুরআন হাদীস) শব্দদুটো খুব শোনা যায় এছাড়া চিরাচরিত নিয়ম অভ্যাসকেও সুন্নাহ বলা হয় [আল-মুফরাদাত ২৪৫] যেমন পবিত্র আল-কুরআনে রয়েছে— “এটা আল্লাহ্ সুন্নাহ অর্থাৎ চিরাচরিত নিয়ম যা পূর্বেও ছিল [সূরা আল-ফাত্ ২৩] আর পরিভাষায় সুন্নাহ-এর বেশ কিছু অর্থ পাওয়া যায় একইমাম ইবনু হাজম (রাহঃ) বলেন, সুন্নাহ তিন প্রকার নবীজির কথা, তাঁর কাজ এবং তাঁর অনুমোদন অর্থে সুন্নাহ হাদীস-এর সমার্থক দুইনবীজির কথা, কাজ অনুমোদন এবং সাহাবাদের কথা কাজ তিনইমাম শাতেবী (রাহঃ) বলেন, নবীজি থেকে যা কিছু বর্ণীত হয়েছে, বিশেষ ভাবে যে বিষয়ে কুরআনে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ নেই চারসাহাবাদের কর্মসমূহ, কেননা তাঁরা কেউই সুন্নাহ্ নির্দেশনা ছাড়া মনগড়া কোনো কাজ করতেন না পাঁচবিদ্‌’আত (শরীয়তে নব আবিষ্কৃত রীতি বা অপসংস্কৃতি)-এর বিপরীত শব্দ সুন্নাহ ছয়ফরজ (অত্যাবশক) ওয়াজিব (আবশ্যক) কাজ ছাড়া যে কাজগুলো নবীজি নিয়মিত করতেন শরীয়তের পরিভাষায় সেই কাজগুলোকেও সুন্নাহ বলে [ইহ্কামুল আহ্কাম /, নুরুল আন্ওয়ার ১৭৩, আল-মুওয়াফাকাত /-, কিতাবুত তারীফাত ৮২] এই সজ্ঞাগুলো থেকে বোঝা যায় যে, সুন্নাহ শব্দটি সম্পূর্ণ রূপে হাদীস-এর সমার্থক নয় কেননা, সুন্নাহ বলতে অধিকাংশ সময় নবীজির কর্ম কর্মপদ্ধতি বোঝায় পক্ষান্তরে হাদীস বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নবীজির কাজ-এর পাশাপাশি কথা অনুমোদনকেও বোঝায় আর তাই ইসলামী সাহিত্য, দর্শন ইতিহাসের আলাপআলোচনা ও লেখালেখিতে নবীজির আদর্শ, চেতনা, বানী বিধিনিষেধ বোঝাতে হাদীস-এর পাশাপাশি আসার, খবর সুন্নাহ শব্দগুলিরও ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়

[পূবের কলমঃ দ্বীন দুনিয়া – ২৭ জুন ২০২৫, শুক্রবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩২-এ প্রকাশিত]